ভোর সাড়ে চারটা।প্রথম আযানের ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ঘুম ভেঙে যায় রেনুফা বেগমের।চটজলদি উঠে ওযু করে চলে যান নামাজ খানায়।আলমারি থেকে কুরআন শরীফ আর জায়নামাজ নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় জায়নামাজ বিছিয়ে সামনেই কুরআন শরীফটা রাখেন।নামাজ শেষ করেই কুরআন তিলাওয়াত করতে বসেন।এখনো চারপাশ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে।
স্টেডিয়ামের প্রত্যেকটা কোণায় কোণায় লোক লাগিয়ে রেখেছে অর্ক!ড্রেসিং রুমে যাওয়ার রাস্তার পাশের গ্যালারিতে একদম কিনার ঘেঁষে থাকা সিটের টিকিট টা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অর্কের জন্য জোগাড় করেছে।এখানে বসে আজকে কিরণ চৌধুরীর প্রত্যেকটা কদমের পই পই করে হিসাব রাখবে বলে।হুডির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে দর্শক সারিতে বসে আছে অর্ক।
– এই তোরা আবার এসেছিস? দরজা খুলে খুন্তি উঁচিয়ে নিয়ে কথাটা বললেন আয়েশা বেগম।কিন্তু সামনে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।খুন্তি উঁচিয়ে রাখা হাতটা চটজলদি নামিয়ে নেন।বিস্মিত হয়ে বললেন, – মেহেনূর তুমি! আয়েশা বেগমের রণচণ্ডীর রূপ দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায় মেহেনূর।
প্রেমিকার কাছে প্রতি রাতে নিয়ম করে ব্যক্তিগত ছবি চাওয়া ছেলেটাও দিনশেষে একটা লক্ষ্মী বউয়ের স্বপ্ন দেখে।টাইটফিট পোশাক পড়ে,রকমারি ফ্যাশন করে, বুক উঁচিয়ে চলা মেয়েটা ছেলেদের গার্লফ্রেন্ড হিসেবেই উপযুক্ত!ঘরের বউ হিসেবে নয়!অথচ বোকা মেয়ে গুলো ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে, ভালোবাসাকে আকঁড়ে ধরে রাখতে গিয়ে নিজের মূল্যবান সম্পদ নষ্ট করে দেয়।
– এই বাড়িতে পা রাখার সাহস কি করে হলো তোর? গেস্ট রুম থেকে কথাটা অর্কের কানে আসতেই থমকে দাঁড়ায়।সামনে থাকা মেহরাব সাহেবের দিকে ভয়ার্ত চোখ তাকিয়ে আছে অর্ক।মেহরাব সাহেবের চোখ থেকে যেন আগুন ঝড়ছে।মুহূর্তেই কান গরম হয়ে আসে অর্কের।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে দাঁত কড়মড় করে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বললো,
গত কয়েক দিন এনজিওতে আসতে না পারায় অর্কের অনেক কাজ জমে গেছে।হাতে থাকা ঘড়িটায় বারবার তাকাচ্ছে আর ফাইলে কিছু লিখছে।অনেকটা রাত হয়ে গেছে তাই অয়নকে দিয়ে তনিমা আর কলিকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।দিহাদ অর্ককে ছাড়া বাসায় ফিরবে না।
নেশায় ভোর হয়ে ব্যালকনিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল অর্ক।সূর্যের তীর্যক রশ্মি চোখে মুখে পড়তেই বিরক্তিতে কপাল কুচকে আসে অর্কের।চোখ খুলে নিজেকে মেজেতে বসে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয় অর্ক।পরমুহূর্তেই গত রাতের কথা মনে পড়তেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
রাওনাফ সোজা ওদের বাড়ির সামনে এনে গাড়ি থামায়।গাড়ি থামতেই মেহেনূর তাড়াতাড়ি করে নেমে দৌঁড়ে বাড়ির ভিতরে চলে যায়।অর্ক মেহেনূরের দিকে এক পলক তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায়।রাওনাফ সিট বেল্ট খুলতে খুলতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে রোশনি এখনো ল্যাপটপেই মুখ গুজে বসে আছে।
বিকালের দিকে রাওনাফ রোশনি আমার মেহেনূর শহর দেখবে বলে বেড়িয়েছে।যাওয়ার সময় অর্ককেও এক প্রকার জোর করেই নিয়ে আসা হয়েছে।অর্ক কিছুতেই আসতে চাইছিল না। কিন্তু রোশনি কি আর কম চালাক মেয়ে।
রোশনি চমকে গিয়ে চটজলদি উঠে দাঁড়ায়। সামনে এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে পানির মধ্যে কি পড়লো।লেকের ধারে ফুল বিক্রি করছিল ছোট ছোট কয়েকটা ছেলে মেয়ে।মেহেনূর ওদের সাথে খুব খুশমেজাজে গল্প করছিল।কিন্তু হঠাৎ করেই পানিতে এমন ধড়াম করে শব্দ হওয়াতে ওউ চমকে উঠে।
– তোদের দুজনেরই হঠাৎ করে এমন ঠান্ডা লেগে গেলো কি করে?বিকালে বাসা থেকে তো দিব্যি ভালো বের হয়েছিলি। আয়েশা বেগম রোশনি আর রাওনাফকে ডিনারের জন্য উনাদের বাসায় নিয়ে এসেছে।
অর্কের সাথে রাওনাফ পুরো এনজিওটা ঘুরে দেখলো।রাওনাফ দেখলো এখানে একটা অনাথ আশ্রম আছে সাথে একটা স্কুলও আছে।রাওনাফ অনাক হয়ে অর্ককে জিজ্ঞাস করলে অর্ক বললো,বাচ্চারা এখানেই থাকে আর এখানেই পড়াশোনা করে।অয়ন, কলি, তনিমা আর দিহাদ ওদের ক্লাস নেয়।
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো মেহেনূর।অর্ক মেহেনূরের চলে যাওয়া পথের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।দ্রুত পায়ে এগিয়ে ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসে অর্ক।
– আন্টি আপনার ছেলের কি কোনোদিনও আক্কেল জ্ঞান হবে না? দিহাদ করুন চোখে তাকিয়ে আছে আয়েশা বেগমের দিকে।কালকে বিকালে এনজিও থেকে অর্ক বেড়িয়ে আসার পর অর্কের ফোনের অনেকগুলো কল দিয়েছিল দিহাদ।কিন্তু রিসিভ করে নি ও।তারপর সন্ধ্যার দিকেও অনেক গুলো কল দেয় দিহাদ।অর্ক তখনও ওর কল রিসিভ করে নি।
অর্ক বিষন্ন মনে এনজিও থেকে বেড়িয়ে সোজা মেহেনূরদের বাড়িতে চলে আসে।তারপর ওখান থেকে রাওনাফকে নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে যায়।
যখন অর্কের ঘুম ভাঙে তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটার গন্ডি পেরিয়ে বারোটার ঘর ছুঁইছুঁই।বাড়িতে বিয়ের আমেজ বলে কথা।হট্টগোল হবে এটাই তো স্বাভাবিক।মেহেনূরদের বাসার হৈচৈও অর্কদের বাসা থেকে শুনা যাচ্ছে।আত্মীয় স্বজনরা সবাই আসতে শুরু করেছে।এত হৈহল্লার মধ্যেও অর্ক সজাগ হয় নি!অর্কের ঘুম ভাঙে রাওনাফের চিৎকারে।
ঘুম থেকে জেগে প্রতিবারের ন্যায় আজো অর্ক নিজেকে ব্যালকনিতে আবিষ্কার করলো।তবে অন্যদিনের তুলনায় আজকে অর্কের সাথে ব্যাতিক্রম ঘটনা ঘটেছে।প্রতিবার এই ব্যালকনিতে ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে হয়তো আয়েশা বেগমের ডাকাডাকিতে অর্কের ঘুম ভাঙে
– তোমার বিয়ে হয়েছে? আমেনা বেগম মুখভর্তি পান চিবাতে চিবাতে প্রশ্ন ছুড়লেন তাঁর পাশেই বসে থাকা মেহেনূরের দিকে।রাওনাফ আর রোশনির বিয়ে উপলক্ষে অর্কদের গার্ডেনটাকে খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে।এই গার্ডেনেই হলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠানটা করা হবে। এখন রাওনাফ আর রোশনির ফটোশুট চলছে।স্টেজের সামনে পেতে রাখা আসনগুলোয় সবাই বসে আছে।
– কিরে তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আচমকায় মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে আয়েশা বেগম একটু চমকে উঠলেও পরমুহূর্তেই মায়ের দিকে ফিরে নরম কন্ঠে বললো
টস রাউন্ডে জিতেছে অর্কের টিম।এখন ওদের টিম থেকে যেকোনো একজন নিজের পছন্দের যেকোনো একটা মুভির গান দিয়ে প্রথম পারফর্ম করার সুযোগ পাবে।আর প্রতিপক্ষ দলকে একটা গান ওরা সিলেক্ট করে দেবে এবং ওই গানেই ওদের নাচতে হবে।